মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন

ঘুষখোরদের ওপর আল্লাহর লানত

ঘুষখোরদের ওপর আল্লাহর লানত

গোলাম রাজ্জাক কাসেমী:

অবৈধ আয়ের উদ্দেশ্যে জনগণের ওপর কখনও সরাসরি কখনও পরোক্ষভাবে জুলুম করা হয়। নানা অজুহাতে ছলেবলে কৌশলে অথবা বাধ্য করে জনগণের ঘাম ঝরানো অর্থ-শ্রম অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হয়। এতে জনগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি সমাজে সৃষ্টি হয় বিরোধ, অসন্তোষ। দরিদ্র, অসহায় ও সাধারণ লোক তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ছড়িয়ে পড়ে কলহ, বিশৃঙ্খলা ও হিংসা-বিদ্বেষ।

কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়া যে কাজ আঞ্জাম দেওয়া কর্তব্য, সে কাজের বিনিময় নেওয়া কিংবা স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার ওপর অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এর কারণ যদি হয় সত্যকে মিথ্যা বলা, মিথ্যাকে সত্য বলা, অযোগ্যকে যোগ্যের আসনে বসানো কিংবা কাউকে জুলুম করা, তাহলে তা হবে আরও জঘন্যতম অপরাধ। কারণ তার উদ্দেশ্য থাকে তখন অপরপক্ষকে ন্যায়ের পথ থেকে সরিয়ে অন্যায়ের পথে জড়ানো। এসব কাজই ঘুষ বা উৎকোচের অন্তর্ভুক্ত। আল্লামা ইবনে আবেদীন (রহ.) লিখেছেনÑ ‘ঘুষ হলো সেটা, যা বিচারক কিংবা অন্য কাউকে সপক্ষে রায় দেওয়ার জন্য অথবা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রদান করা হয়।’ (রদ্দুল মুহতার : ৫/৩৬২)।

সুতরাং ঘুষ শুধু টাকা-পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি অন্যায়ভাবে লাভ করার সব পথ-পন্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন-ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে, তাহলে তা ঘুষ হিসেবে বিবেচিত। অনেক সময় স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘুষ দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সমগ্রী প্রদান করা হয়। সুতরাং যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক, তা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্বের সর্বত্রই এ ঘুষের আদান-প্রদান সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ঘুষ বা উৎকোচবিহীন কোনো কাজই সমাধান হয় না। নিরীহ মানুষ যেখানে যায়, সেখানেই ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াল রূপ দেখতে পায়। শিক্ষকতা করতে ঘুষ লাগে, ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না এবং ন্যায্য অধিকার আদায় হয় না। ঘুষের দুর্দমনীয় প্রভাবে নিরীহ জনসাধারণ হাঁপিয়ে উঠছে। ঘুষ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করা হলেও পরিতাপের বিষয় হলো, আইনপ্রয়োগকারী সদস্যদের গণহারে ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে। বেড়ায় যদি ক্ষেত খেয়ে ফেলে সে ক্ষেতের অবস্থা কী দাঁড়াবে?

ঘুষ আজ অন্য আট-দশটা উপায়ে আয়ের মতোই খুব সহজ ও স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কেউই এটিকে ঘুষ বলতে নারাজ! তারা বরং এটিকে পকেট খরচ, দানাপানি, মালপানি, বখশিশ, সম্মানি, চা-পান, হাতখরচÑ এসব নামে অভিহিত করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একেকটি অফিস বা প্রতিষ্ঠানে এক এক নামে এটি পরিচিত। অবস্থা দেখে মনে হয়, নাম বদল করে তারা এ অপরাধকে কিছুটা হালকাভাবে দেখতে চান। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের এক মন্ত্রী জোর গলায় বলেছিলেনÑ ‘যেটা কোনো কাজের গতি আনে, আমি মনে করি সেটা অবৈধ নয়। উন্নত দেশগুলোতে এটাকে বৈধ করে দেওয়া হয়েছে; তবে ভিন্ন নামে।’

ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বলেছিলেনÑ ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে উপঢৌকন হাদিয়া ছিল। আর এখন তা ঘুষ।’ (বোখারি : ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়)।

বিষের বোতলে মধুর লেবেল লাগালে যেমন মধু হয় না, মাটির টুকরায় স্বর্ণের প্রলেপ দিলে যেমন স্বর্ণ হয় না, তেমনি ঘুষকে যত মনোহরি ও চমকদার নাম নিয়েই ডাকা হোক না কেন, সেটা হারামই থেকে যায়। বৈধ হয় না।

নিম্নোক্ত হাদিসে বর্ণিত ঘটনার দিকে লক্ষ করলে বিষয়টি আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। নবী (সা.) আযদ গোত্রের ইবনু উতবিয়া নামের এক লোককে সদকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেনÑ সে তার বাবার ঘরে কিংবা তার মায়ের ঘরে কেন বসে থাকল না। তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কী দেয় না? যার হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, সদকার মাল থেকে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কেয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, আর গাভী হলে হাম্বা হাম্বা রব করবে, আর বকরি হলে ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে…। (বোখারি : ২৫৯৭)।

ওই হাদিস থেকে এ বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঘুষকে যত চটকদার নামেই নামকরণ করা হোক কিংবা জনগণ খুশি হয়ে প্রদান করুক অথবা কাজের বিনিময় হিসেবে দিয়ে থাকুক, অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বেতন-ভাতা বাদে অন্যের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত অর্থ নিজের জন্য গ্রহণ করা হয়, তার সবই ঘুষ এবং অন্যায়। এতে একপক্ষ অধিক লাভবান হয় এবং অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ইসলাম ও সাধারণ বিবেক কোনোটিই সমর্থন করে না।

যারা ঘুষ নেয় বা দেয় তাদের উদ্দেশে রাসুলে করিম (সা.) সতর্ক করে বলেনÑ ‘ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়ের ওপর আল্লাহর লানত।’ (ইবনে মাজাহ : ২৩১৩)। অপর হাদিসে এসেছেÑ ‘হারাম খাবারে প্রতিপালিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মেশকাত : ২৭৮৭)।

ঘুষ সমাজ ও জাতির অভিশাপ। এর আদান-প্রদান, লেনদেন অন্যায় ও অবিচার। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ ‘তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’ (সূরা মায়েদা : ২)।

আল্লাহ তায়ালা মানুষের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সূরা নিসা : ২৯)।

অপর আয়াতে এরশাদ হয়েছেÑ ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না।’ (সূরা বাকারা : ১৮৮)।

অপরের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে দুনিয়ায়ও সুখী হওয়া যায় না। মজলুম মানুষের অভিশাপে তার জীবন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। মনের ভেতর অস্থিরতা বিরাজ করে। টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, বাড়ি-গাড়ি ও নারীসহ বিলাসিতার সব উপকরণ থাকার পরও জীবন হয়ে ওঠে বিষাদময়। খাবারে তৃপ্তি আসে না, দুচোখে ঘুম আসে না। সারাক্ষণ অস্থিরতার এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ধোঁকে।

এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘যে ব্যক্তি সৎপন্থায় সম্পদ উপার্জন করে তাকে এর মধ্যে বরকত দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি অসৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন যে, সে অনেক খাচ্ছে; কিন্তু পরিতৃপ্ত হচ্ছে না।’ (মুসলিম : ১০৫২)।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877